ঢাকা বলতেই প্রথমেই মাথায় আসে যে ছবি, সেটি শহিদ মিনার।
পৃথিবীর এমন আরও নানা শহিদ স্মারকের মতোই এই মিনারটির আড়ালেও কিছু গল্প আছে।
তেমনই কিছু গল্পের টুকরো আপনাদের শোনাব।
প্রতিটি টুকরোর সঙ্গেই জড়িয়ে আছে ঢাকা শহরের ইতিহাস। ঢাকায় পা রেখে শহিদ মিনার দেখেননি, এমন ট্যুরিস্ট পাওয়াই যাবে না। এমন অজস্র মানুষ আছেন যাঁরা শুধু এই মিনারটি দেখবেন বলেই ঢাকায় আসেন। কিন্তু, বিশ্বজুড়েই যে মিনারের পরিচিতি, সেটি তৈরি হল কী ভাবে, সেই গল্পটিও দারুণ ইন্টারেস্টিং। এবং রুদ্ধশ্বাস। এই রুদ্ধশ্বাস শব্দটি নেহাৎ থ্রিলার অর্থে বলছি না, সকলেই জানেন, সেই সময় ঢাকার পরিস্থিতি কতটা শ্বাসরুদ্ধকর ছিল। ফলে, মিনার তৈরির ঘটনাও যে রুদ্ধশ্বাস হবে, তাতে সন্দেহ কী?
১৯৫২-র ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্রেরা শহিদ হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের পড়ুয়ারা ২৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলেই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়, আর সবাই মিলে সে রাতের মধ্যেই কাজটা করেও ফেলে।
পর দিন, ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহিদ শফিউরের বাবা সেই মিনারের উদ্বোধন করেন। ছবিটা এর পর থেকেই বদলাতে থাকে দ্রুত।
২৬ ফেব্রুয়ারি পুলিশ ও সেনাবাহিনী গিয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র হোস্টেল ঘিরে ফেলে। এবং প্রথমেই শহিদ মিনারটি গুঁড়িয়ে দেয় তারা।
ছাত্ররা দমে যায়নি। এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহিদ মিনার তৈরি করা হয়। তারও আয়ু বেশি দিন ছিল না। সরকারি ফতোয়ায় ভেঙে ফেলা হয় সেই মিনারটিও। কয়েক বছর পরে, বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পেল। অবশেষে ১৯৫৭-তে শুরু হল কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের নির্মাণ। আর্কিটেক্ট হিসাবে বেছে নেওয়া হল দু’জনকে।
বিখ্যাত চিত্রশিল্পী হামিদুর রহমান এবং ভাস্কর নভেরা আহমেদ।
দুই শিল্পীর রূপকল্পনায় ছিল মাঝখানে সুউচ্চ একটি কাঠামো। যেটি কি না স্নেহময়ী আনতমস্তক মায়ের প্রতীক। এটির দু’পাশে সন্তানের প্রতীকস্বরূপ ছোট মাপের দুটি করে কাঠামো। সামনে বাঁধানো চত্বর। পিছনে দেয়ালচিত্র। সামনের চত্বরে দুটি ম্যুরাল। সঙ্গে সন্তানহারা মায়ের কান্নার প্রতীক হিসেবে ফোয়ারা।
এই যদি মিনারের নির্মাণ-নকশা হয়, তা হলে এর সঙ্গেই ছিল মূল বেদিটির নীচের কক্ষে ভাষা আন্দোলন সম্পর্কিত একটি মিউজিয়ম তৈরির পরিকল্পনা। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বরে শুরু হল কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের নির্মাণ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের সামনে বিস্তৃত এলাকা এই নকশার মধ্যেই পড়ে গিয়েছিল। পরবর্তী কালে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য মূল নকশার কিছু কাটছাঁট এবং পরিবর্তন করা হয় বটে, কিন্তু ১৯৫৮-তে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান পাকিস্তানে সামরিক আইন জারির পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তৈরির পুরো কাজটাই বন্ধ হয়ে যায়। এই কাজ ফের শুরু হয় কিছুকাল পরে। নির্মাণ কাজের তত্ত্বাবধান করার দায়িত্ব পায় একটি কমিটি, যার নেতৃত্বে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেন। মূল নকশা ছেঁটে-কেটে দ্রুত শেষ করা হয় নির্মাণ কাজ। মূল নকশার ফোয়ারা, নভেরা আহমেদ-এর ম্যুরাল ইত্যাদি বাদ পড়ে। নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৯৬৩-এর শুরুতে। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম ওই বছরের একুশে ফেব্রুয়ারি নতুন শহিদ মিনারের উদ্বোধন করেন।
image:মাতৃভাষা
তারপর ১৯৭১-এর সেই কুখ্যাত ২৫মার্চ, যে দিন শুরু হয়েছিল গণহত্যা। সে রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোলাবর্ষণে শহিদ মিনার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে তা নতুন করে নির্মাণ করা হয় ঠিকই, কিন্তু ইতিহাস এ কথাও বলবে যে, কোটি কোটি বাংলাভাষীর প্রাণের শহিদ মিনার তৈরির মূল পরিকল্পনাটি আজও হিমঘরেই থেকে গিয়েছে।
শেষ করার আগে আর একজনের কথা যাঁকে বাদ দিয়ে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কোনও দিনই সম্পূর্ণ হবে না। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নামটি চেনা লাগছে কি? যাঁরা বাংলাদেশ, মানে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের ইতিবৃত্ত নিয়ে চর্চা করেন, তাঁদের হয়তো অচেনা মনে হবে না, কিন্তু আমবাঙালির অনেকেই তাঁকে না-ও চিনতে পারেন। তাঁর কথা বলতে গেলে একটু ইতিহাসে ডুব দিতে হবে।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে, এই প্রশ্নের শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর। ১৯৪৮-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব আনা হয়, যদিও মোট জনসংখ্যার মাত্র ৫% উর্দুতে আর ৫৬% বাংলাতেই কথা বলত। এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেন গণপরিষদে পূর্ববঙ্গের কংগ্রেস দলীয় সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তাঁর কথা সকৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেছেন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটিতে বঙ্গবন্ধু কী লিখেছেন, শুনুন — ‘করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ে আলোচনা চলছিল। মুসলিমলীগ নেতারা ঊর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবী করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা।’
সেই যে ছড়িয়ে পড়ল আগুনের ফুলকি, সেটাই পরে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল গোটা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাক সেনার হাতেই নিজের ভিটেবাড়িতে নির্মম ভাবে খুন হন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। বাংলা ভাষার ইতিহাসে তাঁর স্থান চিরকাল উজ্জ্বল হয়ে থাকবে
About The Author
Antor Ali
Hi..!! This is Antor Ali from Kushtia district. I am a university student. I am now studying in the Department of Marketing at University of Rajshahi. This is my blog site & It’s such a place where I can easily share my feelings, emotions & thoughts without any hesitation. I hope you will like my writing, if you read these.
Comentarios: